গণিতের ভীতি দূর করার উপায় সমূহ।
গাণিতিক যুক্তি ও মানসিক দক্ষতা।
“বিজ্ঞানের সাথে সাথে গণিতের ভীতি আমাদের প্রথম কুপোকাত করে অষ্টম শ্রেণিতে। ভয়ের তাড়নায় নবম-দশমে এসে অনেক সম্ভাবনাময় শিক্ষার্থী বিজ্ঞান ছেড়ে মানবিক ও বাণিজ্যের দিকে মোড় নেয়। ঐ সময়ের নিরিখে বিসিএস বা চাকরির প্রস্তুতিকেন্দ্রীক কোনো বিবেচনা কাজ করে না। একজন শিক্ষার্থী শিক্ষা জীবন শেষ করে যখন নিজেকে চাকরি বাজারে আবিষ্কার করে, তখন বুঝতে পারে অঙ্ক ভয় পেয়ে বিজ্ঞানে না পড়া বা অঙ্কে কম মনোযোগ দেয়ার ফলাফলটা আসলে কতটা বাজে!
বিজ্ঞানে পড়তেই হবে, বিষয়টা এমনও না। মানবিক ও বাণিজ্যেও গণিত যেহেতু বাধ্যতামূলক, সেসময়ে ফাঁকি না দিয়ে মনোযোগ দিয়ে সব শিখলেই পরবর্তীতেও ভালো করা সম্ভব। বাস্তবতা হলো মানবিক-বাণিজ্যের শিক্ষার্থীরাই গণিতে একটু পিছিয়ে থাকে। বিজ্ঞানের সবাই গণিতে স্বাভাবিকভাবেই ভালো করে। তাদের জন্য পরামর্শের ধৃষ্টতা আমার নেই। যারা গণিতে একটু দুর্বল এবং শুরু করতে চাচ্ছেন, তাদের জন্য কিছু কথা-
১. বিসিএসের সুনির্দিষ্ট সিলেবাসের সুবিধা হলো প্রশ্ন প্যাটার্ন ধরতে পারলেই প্রস্তুতি নেয়াটা সহজ হয়ে যায়। গণিতের ক্ষেত্রে এটি আরও সহজ কেননা প্রশ্নের ধরণে পরিবর্তন খুব কমই আসে। ৩৫-৪১ পর্যন্ত প্রশ্ন দেখলেই বুঝবেন।
২. গণিতের ২ ঘন্টার পরীক্ষায় প্রশ্ন থাকে ১২টি। প্রতিটি ৫ নম্বর করে ১০টি মূল প্রশ্নের উত্তর করতে হয়, যদিও কোনো কোনো প্রশ্নে দুই বা ততোধিক খন্ডাংশ থাকতে পারে। নম্বর তোলার জন্য এই সিস্টেমই সুবিধার।
৩. মোট ১২০ মিনিটে আপনাকে ১০ টি গাণিতিক সমস্যার সমাধান করতে হবে, যেখানে প্রতিটির জন্য সময় পাবেন ১২ মিনিট। ভালো প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষায় উত্তর করার জন্য এটি মানসম্মত সময়।
৪. বিগত সালের প্রশ্নগুলো বিশেষ করে ৩৫তম বিসিএস থেকে আসা প্রশ্নগুলো বিশ্লেষণ করে প্রস্তুতি নিলে যারা গণিতভীতিতে আক্রান্ত, তারাও কমপক্ষে ৩০-৩৫ অনায়াসে তুলতে পারবেন। লিখিত গণিত অংশ যারা একেবারেই বাদ দিতে চান, তারাও সীমিত ও গুছানো প্রস্তুতির মাধ্যমে এটা করতে পারেন।
৫. বিগত প্রশ্নগুলোকে মূলত সাধারণ গণিতের বীজগণিত, পাটিগণিত, জ্যামিতি, ত্রিকোনমিতি, পরিমিতি ও উচ্চতর গণিতের বিন্যাস – সমাবেশ এবং স্থানাঙ্ক জ্যামিতি এই কয়েকটা স্তরে ভাগ করা যায়।
৬. পূর্বে পাটিগণিতের প্রশ্নের প্রাধান্য দেখা গেলেও বর্তমানে এই অংশের প্রশ্ন সংখ্যা কমে গেছে। পাটিগণিতের বিশাল সিলেবাস থেকে ঐকিক নিয়ম, মুনাফা, শতকরা ও লাভ-ক্ষতি থেকে প্রশ্ন আসতে পারে। বাকিগুলো এখন তেমন গুরুত্বপূর্ণ না। সর্বোচ্চ ১০-১৫ নম্বরের আসে এখান থেকে।
৭. বীজগণিত অংশ সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ৩৫ থেকে ৪০ নম্বরের প্রশ্ন বীজগণিত থেকেই হয়। বীজগাণিতিক সূত্রাবলী, উৎপাদকে বিশ্লেষণ, সমান্তর ও গুণোত্তর ধারা, সূচক ও লগারিদম, সেট এবং সমীকরণ- এই টপিকগুলো মোটামুটি কনফার্ম। প্রায় প্রতিবারই এই বিষয়গুলো থেকে প্রশ্ন হয়।
৮. উচ্চতর গণিতের বিন্যাস ও সমাবেশ, সেট ও ভেনচিত্র, সম্ভাব্যতা এবং স্থানাংশ জ্যামিতি থেকে প্রায় প্রতিবারই প্রশ্ন এসেছে। এই চারটি টপিক থেকে আগামীতেও প্রশ্ন আসবে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। তাই এগুলো অবশ্যই অনুশীলন করবেন।
৯. ত্রিকোনমিতির ক্ষেত্রে প্রশ্ন হয় অনুপাতের সমস্যা ও দূরত্ব-উচ্চতার সমস্যা থেকে। অনুপাতের অঙ্কগুলো কঠিন মনে হলে বাদ দিতে পারেন। দূরত্ব-উচ্চতার অঙ্কগুলো অবশ্যই করবেন। একটা থাকবেই। সবচেয়ে কমন প্রশ্ন থাকে এই অধ্যায় থেকেই।
১০. ত্রিভুজ ও বৃত্ত সম্পর্কিত প্রশ্নগুলো হুবহু বই থেকেই কমন পাবেন। নবম-দশমের বই থেকে উপপাদ্যগুলো মুখস্ত করে ফেলুন। অনুশীলনীভিত্তিক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলো সমাধান শিখে ফেলুন। কমন নিশ্চিত।
১১. পরিমিতির সরলক্ষেত্র ও ঘনবস্তুর অংশটি চাইলে বাদ দিতে পারেন। অনেক বড় চ্যাপ্টার কিন্তু প্রশ্ন আসার হার তেমন বেশি না। তবে অপেক্ষাকৃত সহজ হওয়ায় একেবারে বাদ না দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলো দেখতে পারেন।
১২. প্রস্তুতি শুরুর জন্য যাদের বেসিকে দুর্বলতা আছে, তারা প্রয়োজনে আগে অষ্টম, নবম-দশম এসব বই থেকে প্রাকটিস করুন। বেসিক ম্যাথ টাইপের বইগুলো দেখতে পারেন। উচ্চতর গণিত থেকে প্রাসঙ্গিক অধ্যায়গুলো প্রাকটিস করুন। মনে রাখবেন, উচ্চতর গণিত কঠিন কিছু না, নিয়মিত অনুশীলনে সবই সহজ হয়ে যায়।
১২. পাঠ্যক্রমের বইগুলোতে সব গোছানোই থাকে। এসব অনুশীলন করাই যথেষ্ট। যদি একান্তই মনে হয় বাজারের বই থেকে পড়বেন, তবে ম্যাথ আওয়ার বা ম্যাথ ককটেল বইগুলো পড়তে পারেন। এর বাইরে ওরাকল ম্যাথ লিখিত বইটি ভালো।
১৩. পুনশ্চঃ বিন্যাস ও সমাবেশ, সম্ভাব্যতা, ভেনচিত্র, স্থানাঙ্ক জ্যামিতি, ত্রিকোনমিতি, বীজগাণিতিক সূত্রাবলী ও উৎপাদক, ধারা, সূচক ও লগারিদম এবং জ্যামিতির কিছু উপপাদ্য আত্মস্থ করেই গাণিতিক যুক্তির ৫০ মার্কের মধ্যে ৪০-৪৫ পেয়ে যাবেন। তাই গণিতকে অচ্ছুৎ না রেখে, প্রস্তুতি নিন বুঝে শুনে।
১৩. গুগল ও ইউটিউব কাজে লাগান। কোনো সমাধান বইয়ে না বুঝলে গুগল করুন। ইউটিউবে ভিডিও দেখুন। এটি আপনার কোচিং নির্ভরতা কমিয়ে দিবে। প্রায় সব প্রকাশনিরই ইউটিউব চ্যানেল আছে, যেখানে ভিডিওগুলো সবার জন্য উন্মুক্ত। এর সর্বোত্তম ব্যবহার করুন।
১৪. সূত্র ভুলে যাওয়া সাধারণ একটি রোগ। প্রয়োজনীয় সূত্রাবলি লিখে প্রয়োজনে টেবিলে বা সহজে ও বারবার চোখ পরে এমন স্থানে ঝুলিয়ে রাখুন। একসময় সব আয়ত্তে চলে আসবে।
১৫. পরীক্ষায় গাণিতিক সমস্যার সমাধান সরাসরি খাতায় লেখার আগে সংক্ষেপে রাফ করে দেখবেন উত্তর মেলাতে পারছেন কি না বা লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারছেন কি না। খাতার শেষের পৃষ্ঠাগুলোতে রাফ করবেন। পরে রাফ অংশটি একটানে কেটে দিবেন। রাফের জন্য একাধিক পেজ ব্যবহার করতে না চাইলে পেন্সিল ব্যবহার করুন।
১৬. গাণিতিক সমস্যা সমাধানের সময় সাইড নোট বা ব্র্যাকেটের মধ্যে পার্শ্বটীকা অবশ্যই লিখবেন। আগের লাইন থেকে পরে লাইনে যদি কোনো সূত্রের কারণে পরিবর্তন আসে, সেই সূত্রের রেফারেন্স অবশ্যই দিবেন। কোনো চলকের মান বসানোর সময়েও ব্র্যাকেটে সাইড নোট দিবেন।
১৬. পরীক্ষায় সাইন্টিফিক প্রোগ্রামেবল ক্যালকুলেটর কোনোভাবেই ব্যবহার করতে পারবেন না। তবে সাধারণ ক্যালকুলেটর ব্যবহারের অনুমতি আছে। ছোটোখাটো হিসেবের সুবিধার জন্য অবশ্যই ক্যালকুলেটর রাখবেন। তবে ক্যালকুলেটর ছাড়াই সমস্যার সমাধান করা প্রাকটিস করুন।
মানসিক দক্ষতাঃ
১. পূর্বতন যত প্রশ্ন আছে, সবগুলো প্রাকটিস করুন। পারলে এমনভাবে আত্মস্থ করুন, যেন প্রশ্ন দেখলেই উত্তর বলতে পারেন। কারণ এখানে প্রশ্ন রিপিট হয় অনেক বেশি।
২. বিগত প্রশ্ন এনালাইসিস করার পর মানসিক দক্ষতায় আর কিছুই বাকি থাকে না। তবে অধ্যায়ভিত্তিক অনুশীলনের জন্য ওরাকল মানসিক দক্ষতার বইটি পড়তে পারেন।
লিখিত পরীক্ষার সবচেয়ে সহজ ৫০ নম্বর বরাদ্দ এই মানসিক দক্ষতা অংশে। ১ ঘন্টায় ৫০টি এমসিকিউ টাইপ প্রশ্নের উত্তর করতে হয়। ওএমআর-এ উত্তর করবেন। প্রতিটি প্রশ্নে এক মিনিটেরও বেশি সময় বরাদ্দ থাকে। এই পরীক্ষায় পঞ্চাশে পঞ্চাশ তোলা অসম্ভব কিছু না। দুয়েকটাতে আটকালে পাশের ভাই-ব্রাদার আছেই তো!
প্রথমত গণিতের ভীতি দূর করুন। প্রয়োজনে সিলেবাসকে নিজের মত শর্ট করে নিন। নিজে নিজে প্রাকটিস করুন। খুব জরুরি মনে হলে কোচিং বা কোনো ভাইয়ার প্রাইভেট ব্যাচে ভর্তি হয়ে যান। গণিতের এই ৫০ নম্বর হাতছাড়া করবেন না। আজকাল বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী বা ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারদের এগিয়ে থাকার রহস্যই গণিত। এখানে সর্বোচ্চ নম্বর তুললে আপনিও এগিয়ে যাবেন। আবারও বলছি, একেবারে হাল ছাড়বেন না। কষ্ট করুন, ফল পাবেন।স্বপ্নের পূর্ণতার জন্য একটু কষ্ট তো করাই যায়!”